একটা সময় সমাজের অর্থনৈতিক সিস্টেম (Economic system) সুদমুক্ত ছিলো। যখন বিশ্বব্যাপী ইসলামি শাসন বিরাজমান ছিলো।
শতো শতো বছর ধরে সেই শাসন চলেছে, কিন্তু সুদি সিস্টেমের কোনো প্রকার প্রয়োজন পড়েনি। তখনও তো জীবন ধারণের সকল কিছু সহজেই হাতের নাগালেই ছিলো। কিন্তু আধুনিক যুগে বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যের প্রভাব বিস্তার হওয়ার সাথে সাথে মানব সমাজে সুদি কারবারের সয়লাব হয়ে যায়।
এর মূলে ছিলো গরিবের সম্পদ কুক্ষিগত করে ধনী লোকের রাজত্ব কায়েম করার কঠিন ষড়যন্ত্র। ধীরে ধীরে তাই বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে আজ পৃথিবীর মানুষ মনে করছে, সুদি কারবার ছাড়া সমাজ যেনো চলবে না।
তবুও এ যুগে একমাত্র ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণই সুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তাই ধর্মোদ্রোহিতার এ যুগেও ইসলামপ্রিয় মুসলিমগণ সুদ, জুয়াকে হারাম মনে করে!
ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা
তাই বৈধ পন্থায় টাকা পয়সা জমা রাখা ও ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে মুসলিমদের জন্য প্রচলিত সুদি ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ও স্টোক এক্সচেঞ্জের বিকল্প হিসেবে ইসলামি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে। যাতে ইসলামি অর্থনীতির আলোকে মানব জীবনের বৈধ ব্যবসার শরয়ী পদ্ধতি থাকবে। সে হিসেবে ১৯৬৩ সনে মিসরে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা করেন ড. আহমাদ নাজ্জার।
তিনি তখন জার্মান সেভিং ব্যাংকের আদলে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এরপর ১৯৭৫ সনে জেদ্দা ইসলামি ডেভলপম্যান্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন ইসলামি রাষ্ট্রও শরিক হয়। সে বছরেই দুবাই ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ১৯৭৭ সনে সুদানে ফয়সাল ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে ইসলামি ব্যাংক
এভাবে ১৯৭৮ সনে মিসরে ফয়সাল ইসলামি ব্যাংক ও জর্ডান ইসলামি ব্যাংক ও ১৯৮৩ সনে মালেশিয়ায় বারহাদ ব্যাংক ইসলামি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামি ব্যাংকের প্রচলন ঘটতে থাকে।
বর্তমানে বিশ্বে চারশোর বেশি ইসলামি ব্যাংক মানুষের সেবায় কর্মরত আছে। ব্যবসায়িক দিক দিয়ে বর্তমানে এসব ব্যাংক অনেক সফল।
ইসলামে মৌলিকভাবে বিনিয়োগের সঠিক পদ্ধতি হলো, শিরকাত (শরিকানা ব্যবসা) ও মুদারাবা। কিন্তু আজকাল ইসলামি ব্যাংকগুলো প্রায় ৯২% লেনদেন মুরাবাহা পদ্ধতিতে করে। কারণ, এতে ক্ষতির আশঙ্কা কম। এই জন্যই মূলত প্রচলিত ব্যাংকগুলো এভাবে ব্যবসা করে।
তবে, তারা ক্ষতির দায়ভার নেয় না। সুতরাং ইসলামি ব্যাংকের উচিত মুরাবাহার পরিবর্তে মুদারাবা ও শিরকাত পদ্ধতিতে বিনিয়োগ বেশি করা। যা ইসলামি অর্থনীতির মৌলিক পদ্ধতি।
ইসলামি ইন্সুরেন্স
ইন্সুরেন্স তথা বীমার আরবি সমার্থ হলো ‘তামীন’। বীমার বিকল্প হিসেবে বর্তমান যুগের আলেমগণ ‘তাকাফুল’ পদ্ধতি প্রণয়ন করেছেন। তাকাফুল মানে কয়েকজন মিলে অর্থ জমিয়ে পরস্পর যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে বিনিয়োগ করা। ১৯৬০ সালে ‘হাইআ কিবারুল উলামা মক্কা’ এই তাকাফুল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৭ সালে মুফতি শফি রহ. ইন্সুরেন্সের পরিবর্তে তাকাফুলের ভিন্ন একটি পদ্ধতির কথা বলেন। তিনি বলেন, গরিবদের উদ্দেশ্যে ধনীরা সম্পদ ওয়াকফ করবে। সেখান থেকে পয়সা নিয়ে গরিবরা বিনিয়োগ খাতে যোগ দিবে।
সর্বপ্রথম ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠান
এরপর ১৯৭৯ সালে সুদানে ‘ইসলামিক ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’ নামে ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধারণা করা হয়, মুসলিম বিশ্বে এটিই সর্বপ্রথম সুবিন্যস্ত ইন্সুরেন্স প্রতিষ্ঠান। এরপর ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ায় মাহাথির মুহাম্মাদের সময়ে ইসলামি ব্যাংকের পাশাপাশি তাকাফুল পদ্ধতিও চালু হয়। এরপর তা ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৫০ টিরও
অধিক রেজিস্টারকৃত ইসলামি ইন্সুরেন্স কোম্পানি রয়েছে। এছাড়া আরো দশটি ইন্সুরেন্স কোম্পানি আছে যেগুলো ব্যাংকের আওতাধীন হয়ে ইসলামি তাকাফুল করে থাকে।
আলেমদের জিম্মাদারি
মনে রাখা দরকার, ব্যাংকিং ও ইন্সুরেন্স সিস্টেম যতোটা ইসলামিক পদ্ধতিতে সমৃদ্ধ হবে, সমাজ ততোটাই সুদ ও জুয়া মুক্ত হতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রচেষ্টা থাকা চাই, যাতে ইসলামি ব্যবসায়িক সিস্টেমগুলো সমাজে ব্যাপকতর হতে পারে! এমনিভাবে বিনিয়োগকারীদেরও উচিৎ তারা যেনো ইসলামি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি থেকে বেশি বিনিয়োগ করে।
এর সাথে সাথে আলেমদের জন্যও উচিৎ যে, নবআবিষ্কৃত সুদি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তে কীভাবে নতুন পদ্ধতিতে ইসলামি শরীয়া মোতাবেক বিনিয়োগ করা যায়, এসব নিয়ে চিন্তা- ভাবনা ও গবেষণা করা।
মানুষকে সুদ থেকে মুক্ত করা
। শুধুমাত্র হারাম হারাম ফোতওয়া দেওয়ার উপর ক্ষান্ত না থেকে উপায় বের করার প্রতিও মনোযোগ নিবদ্ধ করা চাই। এক সময় সমাজের দিকে তাকিয়ে ফোকাহায়ে কেরাম ইস্তেসনা (অর্ডার) পদ্ধতি বের করেছিলেন। বর্তমানেও উলামায়ে কেরাম গবেষণা করে শিরকাতে মুতানাকিসা, ইজারা মুনতাহিয়া বিত তামলিক (এগুলোর সংজ্ঞা সামনে আসবে), এ ধরণের নতুন নতুন পদ্ধতি বের করেছেন।
আর এভাবেই প্রতি যুগের অর্থনৈতিক সিস্টেমকে সামনে রেখে শরীয়া আইন মোতাবেক যুগোপযোগী পদ্ধতি আবিষ্কার করা দরকার।