জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এ আর্টিকেল দ্বারা যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি জানতে পারবেন আর তা হলো,
জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যথা- (ক) স্থায়ী -ব্যবস্থা । এমন পদ্ধতি গ্রহণ করা যা স্থায়ী ভাবে পুরুষ বা নারীর প্রজনন ক্ষমতা তথা সন্তান দেয়া ও নেয়ার শক্তি চিরতরে নষ্ট করে দেয়। সাধারণত এর জন্য নিম্নবর্ণিত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
(১) Vasectomy (ভ্যাসেক্টমি) [অন্ডকোষের নিঃসরণ নালীর ছেদন] অর্থাৎ পুরুষের বন্ধ্যকরণের জন্য সহজ অস্ত্রোপচারবিশেষ। এতে শুক্রকীটবাহী নালীকা অংশত বা সম্পূর্ণ কেটে ফেলা হয়।
(২) Tuval Ligation (টিউবেল লাইগেশন) অর্থাৎ মহিলার শুক্র নালী কেটে ফেলা অথবা কাটা ব্যতীত এমন ভাবে বেঁধে দেয়া, যাতে ধাতুর প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। তবে পরবর্তীতে যদি বাঁধ খুলে দিলে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে তাহলে তা স্থায়ী পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত না হয়ে অস্থায়ী পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।
(৩) Hysterectomy (হিসটারেস্টমি) [জরায়ুচ্ছেদ। অর্থাৎ মহিলাদের জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া যাতে সন্তান গর্ভজাত বন্ধ হয়ে যায়।
উপরোক্ত জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এর হুকুম
উপরোল্লেখিত জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কোন পন্থাই শরীআতের দৃষ্টিতে জায়েয নেই, বরং হারাম। অর্থ- হযরত কায়েস থেকে বর্ণিত, হযরত ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে যুদ্ধাভিযানে যেতাম আর আমাদের কাছে জৈবিক চাহিদা পূরণের কিছু ছিলনা। (এতে আমরা যৌন পীড়নে ভুগতাম) তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে যৌন শক্তি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তা নিষেধ করলেন এবং এটি খারাপ হওয়ার ব্যাপারে উল্লিখিত আয়াতটি পাঠ করেনঃ “হে মুমিনগণ! তোমরা ঐ সব সুস্বাদু বস্তু হারাম করোনা যেগুলো আল্লাহ্ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন এবং সীমালংঘন করো না, নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা মায়িদা, আয়াত: ৮৭] (বুখারী, খ. ২, পৃ. ৭৫৯, হাদীস নং ৫০৭৫) উক্ত হাদীস থেকে এ কথা বুঝে আসে যে, এ আয়াত দ্বারাই স্থায়ীভাবে প্রজনন বন্ধ করা হারাম প্রমাণিত হয় এবং এ কাজ সীমালংঘনের নামান্তর।
أن عثمان بن مظعون وعليا، وأباذر، هموا أن يختصوا ويتبتلوا، فنهاهم رسول الله صلى الله عليه وسلم عن ذلك. ذكره ابن عبد البر في الاستيعاب، كذاعمدة القارى، كتاب النكاح، باب ما يكره من التبتل والخصاء، ٢٠: ٩٥) في
অর্থ- হযরত উসমান ইবনে মাযয়ূন, হযরত আলী ও হযরত আবূ যর (রাযি.) প্রমূখ সাহাবীগণ নপুংসক হয়ে যৌন শক্তি নিঃশেষ করতে চাইলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করলেন। (উমদাতুল ক্বারী, খ. ২০, পৃ. ৯৫) উল্লিখিত হাদীসদ্বয় দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয় যে, স্থায়ীভাবে প্রজনন ক্ষমতা নিঃশেষ করা শরীআত কর্তৃক সম্পূর্ণ হারাম।
ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) বলেনঃ وهو أى الخصاء – محرم بالاتفاق. (عمدة القاری ۲۰ : ٩٥، تحت الحديث: ٥٠٧٣)অর্থ- খোজা-খাসি হওয়া সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। (উমদাতুল ক্বারী, খ. ২০, পৃ. ৯৫, হাদীস নং ৫০৭৩ এর ব্যাখ্যা) তবে যদি জরায়ুতে এমন রোগ দেখা দেয় যা অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু কেটে ফেলা ব্যতীত আরোগ্য লাভ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে এমতাবস্থায় ঐ মহিলার জন্য জরায়ু কেটে ফেলা জায়েয আছে, যদিও এতে স্থায়ীভাবে তার প্রজনন ক্ষমতা বন্ধ হয়ে যায়।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি র অস্থায়ী ব্যবস্থা
এর জন্য সাধারনত নিম্ন বর্ণিত আট (৮)টি জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যথা- (১) সহবাস নিয়ন্ত্রণ
(২) আযল করা (যৌন মিলনে বীর্য প্রত্যাহার করা) আযল সম্পর্কে হাদীসের কিতাব সমূহে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়।
আযল সম্পর্কীয় হাদীসগুলোকে সামনে রাখলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে বিনা কারণে এমন করা নাজায়েয না হলেও মাকরূহ ও গর্হিত কাজ বটে ।
অর্থ- হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, উকাশার বোন হযরত জুদামাহ বিনতে ওহাব বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম, সেখানে আরো লোকজন ছিল তারা আযল সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, এটাতো “الوأد الخفى” তথা শিশুদের জীবন্ত দাফনের নামান্তর… (এবং ইহা আয়াতে কারীমা এর অন্তর্ভুক্ত)। (মুসলিম, খ. ১, পৃ. ৪৬৬, হাদীস নং ৩৫৫০(
উল্লিখিত বর্ণনাগুলোর দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় যে, বিনা প্রয়োজনে আযল করা মাকরূহে তানযিহী।
(৩) কনডম (Condom) ব্যবহার।
(8) Jelly, Cream, Foam (এগুলো Spermicidal বা শুক্রাণুকে অক্ষম করে দেয়ার কাজ করে) ব্যবহার।
(৫) চুস্ (Douche) ব্যবহার অর্থাৎ পানির পিচকারী দিয়ে জরায়ু ধুয়ে ফেলা।
(৬) জরায়ুর মুখ বন্ধ করে দেয়া।
উপরোল্লেখিত ৩, ৪, ৫ ও ৬ এ চারটি পদ্ধতি অবলম্বন করার হুকুম ‘আযলের’ ন্যায়। কেননা এগুলো আযলের সাথে সাদৃশ্য রাখে। সুতরাং বিনা প্রয়োজনে এ পদ্ধতি গুলো গ্রহণ করা নাজায়েয ও মাকরূহ।
(৭) পিল (Pill) খাওয়া।
(৮) ইঞ্জেকশন নেয়া।
উল্লিখিত ৭ ও ৮ এ দু’টি পদ্ধতি অনেক সময় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, যাকে side effect (পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া) বলা হয়। আর যে সমস্ত কাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক, তার ব্যবহার শরীআতের দৃষ্টিতে মাকরূহে তানযীহী। যেমন, মাটি খাওয়া মাকরূহ। কেননা মাটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। (আলমগীরী, খ. ৫, পৃ. ৩৪০)
অতএব, উক্ত পদ্ধতিদ্বয় আযলের সাদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথে দেহের জন্য ক্ষতিকারক হওয়ার কারণে মাকরূহ এর
বিশেষ কিছু দিন সহবাস থেকে বিরত থাকা
অর্থাৎ ঋতুর শুরু থেকে পবিত্র কালের (Purification after menses) মধ্যবর্তী সময় (যা সাধারনত চৌদ্দতম দিন হয়) এবং তার পূর্বাপর কয়েক দিন সহবাস থেকে বিরত থাকা। আর তা হল, ঋতুর শুরু থেকে ৯ম দিন হতে ১৯তম দিন পর্যন্ত। কারণ এ সময় সাধারনত বাচ্চা জন্ম নিয়ে থাকে [গর্ভ সঞ্চার হয়]। এর মধ্যে ১৩, ১৪ ও ১৫তম দিনগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (এ সময়ে বাচ্চা জন্ম গ্রহণের সম্ভাবনা বেশি থাকে)। উল্লিখিত দিনগুলোর পরে মহিলাদের ডিম্বাণুর বাচ্চা জন্মদানের যোগ্যতা নিঃশেষ হয়ে যায়। কারণ এ সময় তাদের ডিম্বাণু দুর্বল হয়ে পড়ে। এ পন্থা অবলম্বন নিঃসন্দেহে জায়েয। কেননা প্রত্যেক স্বামীর এ অধিকার রয়েছে যে, সে যখন ইচ্ছা স্ত্রী সহবাস করবে আর যখন ইচ্ছা বিরত থাকবে। অতএব, সে যদি কিছু দিনের জন্য তার অধিকার অর্থাৎ স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থাকে এতে স্ত্রীর অধিকার লংঘন না হলে তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।
যে সব অবস্থায় অস্থায়ী পদ্ধতি বৈধ
নিম্নবর্ণিত উযর সমূহের কারণে অস্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা জায়েয।
১ . মহিলা এত দূর্বল যে, বাচ্চা ধারণের ক্ষমতা নেই।
৩. ফেতনা-ফাসাদের যমানার কারণে বাচ্চা অসৎ চরিত্র হওয়ার আশংকা থাকা।
৪. মহিলার নিজের বাসস্থান থেকে দূরবর্তী এমন কোন এলাকায় থাকা, যেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার ইচ্ছা নেই এবং সেখান থেকে গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে কয়েক মাসের প্রয়োজন।
৫. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল হওয়ার কারণে পৃথক হওয়ার ইচ্ছা থাকা।
৬. মুসলমান বিজ্ঞ ডাক্তারদের মতানুযায়ী বাচ্চা নিলে মায়ের জীবননাশের আশংকা থাকা।
ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা
যে সব কারণে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বৈধ নয়
নিম্নবর্ণিত কারণগুলো জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বৈধ হওয়ার উষর হিসেবে ধর্তব্য ও গ্রহণযোগ্য নয়।
২. কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার ভয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা। যাতে পরবর্তীতে এদের বিয়ে-শাদির ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
৩. গর্ভধারণ কষ্ট, প্রসব বেদনা, নিফাস (সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরবর্তী স্রাব), দুধ পান করানো এবং এর সেবা-যত্ন ইত্যাদির কষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য।
৪. গর্ভধারণ থেকে নিয়ে বাচ্চা বড় হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে এর সেবা-যত্নের পেছনে কল্পনাতীত শ্রম দেয়ার কারণে সৃষ্ট সম্ভাব্য খিট খিটে মেজাজ থেকে বাঁচার জন্য।
৬. অধিক সন্তান হলে আর্থিক অভাব-অনটন দেখা দিবে, এ ভয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অবলম্বন করা ।
উল্লিখিত কারণসমূহ সামনে রেখে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে নাজায়েয। বিশেষ করে ষষ্ঠ কারণটি ইসলামী আকীদা ও বিশ্বাসের সাথে প্রকাশ্য সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এর ভয়াবহতা অনেক বেশী। অথচ এই কারণকে সামনে রেখে অধিকাংশ মানুষ এ পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে।
আর্থিক দুর্বলতা ও সচ্ছলতা এবং রিযিকের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আল্লাহ তা’আলার হাতে নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহ পাক বলেনঃ
অর্থ- আর পৃথিবীতে কোন বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন। তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত। সুস্পষ্ট কিতাবে সব কিছুই আছে। (সূরা হূদ, আয়াত: ৬)
অর্থ- স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্র্যের কারণে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে রিস্ক দেই। (সূরা আনআম, আয়াত: ১৫১)
যখন উল্লিখিত আয়াতগুলো দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, সমষ্টিগত ভাবে প্রত্যেক বিচরণশীলের জীবিকার ব্যবস্থা আল্লাহ তা’আলা নিজ দায়িত্বে রেখেছেন, তখন মানুষের জন্য তার এ দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নেই। কেননা এ দায়িত্ব পালন ক্ষমতা আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কারোর নেই।
একটি ভুল ধারণা ও তার নিরসন
لا تقتلوا أولادكم الخ، تمام সন্তান হত্যা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাঝে পার্থক্য করতে চায়। তাদের দাবি হলো, উক্ত আয়াতে সন্তান হত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে, জন্ম নিয়ন্ত্রণকে নয়। একটি ছোট কীট বিনষ্ট কারীর উপর গোটা বৃক্ষের জরিমানা চাপিয়ে দেয়া যায় না।
তাদের এ দাবি ও যুক্তি সম্পূর্ণ ভুল। কেননা কুরআনের আয়াত শুধু لا تقتلوا أولادكم” পর্যন্ত বলে ক্ষান্ত হয়নি বরং সামনে ‘خشية إملاق نحن نرزقكم واياهم ؟’ বলে একটি মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, সন্তান সীমিত রাখার ব্যাপারে ঐ সকল কাজকে অবৈধ ও নাজায়েয বলে ঘোষণা করা হয়েছে যা দরিদ্রতার ভয়ে করা হয়। এর বিশ্লেষণ এই যে, সন্তান হত্যা তো সর্বাবস্থায় নাজায়েয। চাই তা দরিদ্র্যতার ভয়ে হোক কিংবা অন্য কোন কারণে।
نحن نرزقكم وإياهم . خشية إملاق কস্মিনকালেও এ হতে পারেনা যে, দারিদ্রের ভয়ে সন্তান হত্যা নাজায়েয আর অন্য উদ্দেশ্য হল জায়েয।সুতরাং উক্ত বাক্য দু’টি সংযোজনের মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে এ ভুল ধারণার মূলোৎপাটন করা হয়েছে যে, রিযিকের ব্যবস্থা মানুষের নিজ দায়িত্বে ন্যস্ত। বরং এ দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলার, তাই তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন এ বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুল যে, অধিক সন্তান দরিদ্রতার কারণ হয়। অতএব, দরিদ্রতার ভয়ে সন্তান সীমিত রাখা সর্বাবস্থায় নাজায়েয। চাই তা সন্তান হত্যার মাধ্যমে হোক অথবা শুক্রকীট বিনষ্টের মাধ্যমে হোক।
যারা জন্মনিয়ন্ত্রনকে বৈধ সাব্যস্ত করে
কিছু সংখ্যক মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কে কোন প্রকার শর্ত ব্যতীত নিরংকুশভাবে বৈধ মনে করে, তারা তাদের এ দাবির স্বপক্ষে ঐ সমস্ত হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে যেগুলো দ্বারা আযল জায়েয হওয়া বুঝে আসে। যেমনঃ
১. অর্থ- হযরত জাবির (রাযি.) বলেন, কুরআন অবতরণযুগে আমরা আযল করতাম। হযরত সুফিয়ান (রহ.) বলেন, যদি আযল করা নিষেধাজ্ঞার বিষয় হতো, তাহলে কুরআন আমাদেরকে তা নিষেধ করতো। হযরত জাবির আরো বলেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম এর যামানায় আযল করতাম। এ সংবাদ তার নিকট পৌঁছা সত্ত্বেও তিনি আমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করেননি। (মুসলিম, খ. ১, পৃ. ৪৬৫, হাদীস নং ৩৫৪৬)
উত্তরঃ যারা দলীল হিসেবে এ হাদীসগুলো পেশ করেন, তারা এ কথা চিন্তা করেন না যে, এ হাদীসগুলো আযল সম্পর্কীয়, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কীয় নয়। না জেনে শুনে যদি এমন করে থাকেন তবে তো তারা মা’য়ূর। আর যদি জেনে শুনেই এমন করে থাকেন তাহলে তা ধোকার নামান্তর। দ্বিতীয়তঃ তারা নিষেধাজ্ঞার হাদীসগুলোকে উপেক্ষা করে যান। অথচ শরীআতের কোন হুকুম জানার জন্য সব ধরণের হাদীসকে সামনে রেখে বিবেচনা করতে হয়। শুধু এক-দুটি হাদীস দেখেই কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া নিতান্ত বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গভীরতা সম্পর্কে অনুমান করা নিছক নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। সমুদ্রের গভীরতা ও প্রশস্ততা তাদের থেকে জানতে হবে, যারা জীবন বাজি রেখে পাহাড় সম উত্তাল তরঙ্গমালার সাথে মোকাবেলা করে কাঙ্খিত মুক্তা আহরণ করে থাকে।
যে আলেমগণ কুরআন ও হাদীস চর্চায় নিজের পূর্ণ জীবন ও শ্রম ব্যয় করেছেন, তারা উভয় ধরণের হাদীসগুলোকে সামনে রেখে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তাদের সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হবে। পক্ষান্তরে যারা এক-দু’হাদীসের মামুলী অধ্যয়নের পর আযলের বৈধতার স্বীকৃতি দেয় তা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আলোচিত মাসআলায় যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন
এক্ষেত্রে বিজ্ঞ আলেমগণ হাদীসের ভান্ডার চর্চা করার পর আলোচিত মাসআলায় যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন । তা হলো, বিনা প্রয়োজনে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ মাকরূহ ও নাজায়েয।
যে সমস্ত হাদীস দ্বারা জায়েয হওয়া বুঝে আসে তা কোন না কোন উযর ও সমস্যার কারণে ছিল। তাইতো আযল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রশ্নকারীর নিকট তার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন।
অতঃপর তার উদ্দেশ্য সামনে আসলে, তিনি বাস্তব কথাটি বলে দিলেন যে, তাক্বদীরে যা আছে তা ঘটবেই। অতএব তোমরা আযল করো না। কেননা বাচ্চা হওয়ার থাকলে আযল করলেও তা হবেই।হযরত আবূ সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত উক্ত হাদীসটি শুনার পর
হযরত হাসান বসরী (রহ.) বললেনঃ “والله لكان هذا زجر” অর্থ আল্লাহর শপথ ইহা তো ধমক ছাড়া আর কিছুই নয়। (মুসলিম, খ. ১, পৃ. ৪৬৫)
আযল সম্পর্কীয় হাদীস ব্যতীত তারা নিজেদের স্বপক্ষে নিম্নবর্ণিত হাদীসটিও পেশ করে থাকেন। যথা-২. অর্থ- হযরত আবূ হুরায়রা (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা’আলার নিকট جهد البلاء তথা কম সম্পদ ও অধিক সন্তানাদি থেকে মুক্তি কামনা করতেন। (বুখারী, খ. ২, পৃ. ৯৩৯, হাদীস নং ৬৩৪৭)
অর্থ- হযরত আহমাদ আলী সাহারানপুরী (রহ.) বুখারী শরীফের টিকায় উল্লেখ করেন ।
‘جهد البلاء ঐ অবস্থাকে বলা হয়, যে অবস্থায় মৃত্যুকে প্রাধান্য দেয়া যায় । আবার কেউ (আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি.) বলেন, এর অর্থ হলোঃ সম্পদ কম হওয়া ও সন্তানাদি বেশী হওয়া।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আলোচনার সার সংক্ষেপ
(১) স্থায়ী ভাবে প্রজনন বন্ধকরণ হারাম । তবে যদি জরায়ুতে এমন রোগ দেখা দেয় যার থেকে অপারেশন ব্যতীত পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব না হয় ।
তাহলে জরায়ু কেটে ফেলা জায়েয আছে।
(২) অস্থায়ী জন্ম বিরতি মাকরূহ। তবে উষর বশত জায়েয।
(৩) দরিদ্রতা ও লজ্জার ভয়ে অস্থায়ী ও সাময়িক জন্ম বিরতি মাকরূহে তাহরীমী।
Leave a Reply