তালেবান: ইতিহাস, উত্থান এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট

তালেবান (ইংরেজিতে “Taliban”) আফগানিস্তানে একটি ইসলামিক মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যা শারিয়া আইন অনুসরণ করে এবং আফগান সমাজে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। ১৯৯০-এর দশকে গঠিত এই গোষ্ঠী আফগানিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে তাদের কার্যক্রম এবং শাসন শৈলী বিশ্বে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, তাদের শাসন ও যুদ্ধ কৌশল পশ্চিমা শক্তিগুলোর সাথে দীর্ঘ দশকের সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে।

তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান

তালেবান গোষ্ঠীর জন্ম ১৯৯৪ সালে, আফগানিস্তানের কন্দরহ প্রদেশে। তাদের নেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমর ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতা, যিনি আফগানিস্তানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তালেবান আন্দোলন শুরু করেছিলেন। গোষ্ঠীটির নাম “তালেবান” আরবি শব্দ “তালিব” থেকে এসেছে, যার অর্থ “শিক্ষার্থী” বা “শিক্ষা প্রার্থী”। শুরুর দিকে তালেবান সদস্যরা আফগানিস্তানের বাচ্চাদের ইসলামী শিক্ষা দিতে শুরু করেছিল, কিন্তু পরে তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে দেশব্যাপী শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান আফগানিস্তানের শাসক শক্তি ছিল। এই সময়ে তারা অত্যন্ত কঠোর শারিয়া আইন প্রবর্তন করে, যা দেশের নাগরিকদের জন্য এক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে। মহিলাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সীমিত করা হয়েছিল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তালেবান এই শাসন ব্যবস্থার অধীনে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটিয়েছিল, যার মধ্যে তালেবান সরকার কর্তৃক ঐতিহাসিক বুদ্ধ মূর্তি ধ্বংসও উল্লেখযোগ্য।

২০০১ সালের পরবর্তী অবস্থা

২০০১ সালে ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলার পর, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলি আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং আফগানিস্তানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধ চলে, যেখানে তালেবান গোষ্ঠী গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে এবং সময়ের সাথে সাথে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।

২০২১ সালের পুনরায় ক্ষমতায় অধিকার

২০২১ সালে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান থেকে নিজেদের সেনা প্রত্যাহার শুরু করলে তালেবান দ্রুততার সাথে আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহর দখল করতে শুরু করে। ১৫ আগস্ট ২০২১, তালেবান কাবুল দখল করে এবং আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি দেশ ত্যাগ করেন। এর ফলে তালেবান পুনরায় আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফিরে আসে।

তাদের পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর, তালেবান গোষ্ঠী তাদের শাসন ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনলেও, শারিয়া আইন অনুযায়ী কঠোর শাসন ব্যবস্থা বজায় রেখেছে। মহিলাদের অধিকারের উপর বিধিনিষেধ অব্যাহত রেখেছে, এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দাবি করছে যে তালেবান তাদের পূর্ববর্তী শাসনকালের মতো অত্যাচার এবং নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।

তালেবানের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন

তালেবান ২০২১ সালের পর বলেছে যে তারা “নতুন যুগে” প্রবেশ করেছে এবং তাদের শাসন ব্যবস্থা আগে থেকে কম কঠোর হবে। তারা কিছু “ধর্মীয় সহিষ্ণুতা” এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন অংশের সাথে আলোচনা করার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। তবে, বাস্তবে তালেবান গোষ্ঠী তাদের শাসনে আগের মতই দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে।

আরো পড়ুন

তালেবানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তাদের শাসন ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নয়, কারণ তারা মানবাধিকারের প্রতি যে অঙ্গীকারবদ্ধ, তা তালেবান সরকারের কার্যক্রমে পূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়নি।

তালেবান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

আফগানিস্তানের বর্তমান তালেবান শাসনের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তালেবান তাদের শাসন কায়েম করার পর কিছু দেশ তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আলোচনা শুরু করলেও, বিশেষত মানবাধিকার ও নারীর অধিকার বিষয়ক সমস্যাগুলির কারণে বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ তাদের শাসনকে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে না।

তবে, প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন পাকিস্তান, চীন এবং রাশিয়া, তালেবানকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আলোচনা চালাচ্ছে।

উপসংহার

তালেবান আফগানিস্তানের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বিতর্কিত গোষ্ঠী, যার কার্যক্রম অনেক সময় আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচিত হয়েছে। যদিও তাদের শাসন প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন এসেছে, তবে তাদের শাসন ব্যবস্থা এবং মানবাধিকারের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এখনও অনেক জায়গায় প্রশ্নবিদ্ধ। আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন ভবিষ্যতের দিকে আরও কী ধরনের পরিবর্তন আনবে, তা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নিরাপত্তার ওপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *